[ আজ নিঝুমের বিয়ে ]
দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রেমের স্বার্থক
রুপায়ণ হতে চলেছে আজ।ওর
পছন্দের মানুষের
সাথে বিয়েতে ওর মা বাবাও
তেমন একটা আপত্তি করেন নি।
মা বাবার একমাত্র মেয়ে।
বাবা মা সব সময়ই সব ব্যাপারে ওর
মতামতকে প্রাধান্য দেন।আর
পাত্র হিসেবে ফয়সালও বেশ
যোগ্যতা সম্পন্ন। হ্যাঁ, নিঝুমের
পছন্দের মানুষের নাম ফয়সাল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ
পাস করার পর ফয়সাল এখন বেশ
ভালো বেতনে চাকুরি করছে।
ওদের দুজনের সম্পর্কের সূচনা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ার সময়
থেকেই। ...
লাল শাড়িতে নিঝুমকে আজ
অপূর্ব লাগছে। কিছুক্ষণের মাঝেই
কাজি আসবে বিয়ে পড়াতে ।
নিঝুমের মনে হচ্ছে ও জীবনের
সবচেয়ে মধুরতম সময় পার করছে ।
কিন্তু ওর শরীরটা আজ
বেশি ভালো লাগছে না।কেমন
যেন মাথাটা ব্যথা করছে সকাল
থেকেই। একটু একটু
করে ব্যথাটা বাড়ছে। হঠাৎ
নিঝুমের কাছে সবকিছু
ঘোলাটে মনে হতে লাগলো।
মাথার ব্যথাটা অসহ্য রকম
মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে বিয়ের
আসরে জ্ঞান হারাচ্ছে নিঝুম।
...
নিঝুম এখন হাসপাতালে ভর্তি ।
আইসিইউতে আছে ও । ওর ব্রেন
টিউমার ধরা পরেছে।
জরুরী ভিত্তিতে অস্রোপাচার
করাতে হবে।
না হলে হয়তো ওকে বাঁচানো দুরূহ
হয়ে যাবে। ঠিক তখনই
হাসপাতাল ত্যাগ করলো ফয়সাল
সহ ওর পরিবারের সবাই ।কিন্তু
তারা আর ফিরে আসে নি।আর
কোনো দিনই তাদের
দেখা পাওয়া যায় নি। খোদ
ফয়সালও কখনো আর এমুখো হয়নি।
এরই মধ্যে নিঝুমের মাথায় সফল
অস্ত্রোপচার হয়। দীর্ঘ ৬ মাস
পরে ও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।
কিন্তু ততদিনে জল বহুদূরে গড়িয়েছে।ফয়সাল এর
মাঝেই অন্যত্র
বিয়ে করে ফেলে।
আসলে যে মেয়ের বিয়ের
আসরে বিয়ে ভেঙ্গে যায়
সে একটা অপয়া। এইরকম
একটা অপয়া মেয়েকে ফয়সাল
ঘরে তুলবে কেন। তাছাড়া ওর
মতো অসুস্থ
মেয়েকে বিয়ে করার
কী প্রয়োজনই বা আছে! হোক
না ৫ বছরের প্রেম !! এই কর্পোরেট
যুগে এতো সব
চিন্তা করলে চলে নাকি!এসব
ভেবেই ফয়সাল
বিয়েটা করে ফেলে। সুস্থ
হওয়ার পর যখন নিঝুমের
বাবা নিঝুমকে কথাটা শোনালেন
তখন মেয়েটার
মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য
করা যায় নি।নিঝুম কেবল
ভাবলেশহীন চোখে আকাশের
দিকে তাকিয়ে ছিল।
...
কিছুদিনের মধ্যেই আতিফের
সাথে বিয়ে হয়ে যায় নিঝুমের।
বড়লোকের ছেলে আতিফ।
পুরো নাম আতিফ চৌধুরী।খুব
সাধারণভাবে বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।
নিঝুম এমনটাই ধারণা করেছিল।
তার বিয়ে বড়লোকের
কোনো ছেলের সাথেই হবে।এ
ধরণের ছেলেরা মেয়েদের রূপ
দেখেই পাগল হয়ে পড়ে।তারপর
নেশা কেটে গেলে আস্তে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
অবশ্য বিয়েটা না দিয়ে ওর
বাবার কোনো উপায় ছিল না। এ
বিষয়টা নিঝুম খুব ভালো করেই
বোঝে।কারণ একবার
কোনো মেয়ের
বিয়ে ভেঙ্গে গেলে পরবর্তীতে সেই
মেয়ের বিয়ে দেওয়া খুবই কষ্টকর
হয়ে পড়ে।পরিবারের কাছেও
সে তখন বোঝা হয়ে যায়। ...
আলিশান এক
বেডরুমে বসে আছে নিঝুম।
মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছে।
বিয়ের প্রথম দিনেই
ছেলেটাকে কিছু
কথা শুনিয়ে দেবে সে।
ফয়সালের এমন কান্ডের পর
পুরো পুরুষ জাতির উপর নিঝুমের
ঘৃণা ধরে গেছে।
সে বুঝে গেছে ভালোবাসা হচ্ছে ছেলেদের
কাছে একটি খেলা নাহয়
অভিনয়। না হলে ৫ বছরের প্রেম
সত্ত্বেও কিভাবে তার
দুঃসময়ে ফয়সাল
তাকে ছেড়ে চলে গেছে!
আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করলো !
দরজায় শব্দ হচ্ছে। আতিফ
ভেতরে ঢুকছে।
ছেলেটা খাটে বসা মাত্রই
নিঝুম বেশ শান্ত কন্ঠে বলল,
"আপনার সাথে আমার কিছু
কথা আছে।" "বলো" । বেশ
হাসিমুখেই
কথাটা বললো আতিফ। "আপনার
সাথে এ
বিয়েতে আমি আসলে রাজি ছিলাম
না।কেবলমাত্র মা বাবার
অনুরোধেই আপনাকে বিয়ে করা।
আমার কাছ থেকে কখনো স্ত্রীর
মর্যাদা আশা করবেন না।" "
মানে?"আশাভঙ্গের
দৃষ্টিতে বললো আতিফ।
"মানে খুব সোজা। আপনি এরপর
থেকে এই রুমে প্রবেশ না করলেই
আমি খুশি হবো। আর
যদি আপনি আমার
সাথে বাড়াবাড়ি রকমের কিছু
করতে চেষ্টা করেন,তাহলে আমি আত্মহত্যা করব।
আপনি এখন চলে যেতে পারেন।"
আতিফ কোনো কথা না বলে রুম
ত্যাগ করলো। আতিফের বিশাল
বাড়িতে আতিফ একা থাকে।ওর
বয়স যখন ১০ তখনই ওর মা মারা যায়।
আর বাবা মারা গেছে ১ বছর
হলো।
...
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল ওদের
দিনগুলো।একই
বাড়িতে দুটো মানুষ। অথচ কেউ
কারো সাথে কোনো কথা বলে না।
হঠাৎ একদিন আতিফ এসে বললো,
"একটা কথা ছিল।" "জ্বি বলুন।"
"তোমাকে কিছুদিনের জন্য অন্য
বাড়িতে উঠতে হবে। আমরা অল্প
কিছুদিন সেখানে থাকবো।"
"কবে যেতে হবে?" "আজ
বিকেলে।
তুমি তাহলে জিনিসপত্র
গোছগাছ করে রেখো।" নিঝুম আর
কোনো উত্তর দিল না। কেন অন্য
বাড়িতে যেতে হবে জানতে-ও
চাইল না।আসলে যেখানে তার
ফয়সালকে ঘিরে স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে গেছে সেখানে এখন
অন্য কোনো ব্যাপারে জানার
কোনো আগ্রহ নেই। ...
নতুন বাড়িটা বেশ ছোটো।রুমও
কম। আগে আতিফ ছেলেটা ৩-৪
বার করে বাসায়
আসতো দিনে অফিস থেকে।এখন
তাও আসে না।অনেক রাত
করে ফেরে।তাতে অবশ্য
নিঝুমের কিছু যায় আসে না।
বড়লোকেরা এমনই হয়।সারাক্ষণই
খালি টাকা আর টাকার
পিছনে ছোটে।
একা থাকতে অবশ্য নিঝুমের
খারাপ লাগে না।
কোনো নিঃসঙ্গতা অনুভব
করে না।অনুভূতিগুলো যেন
ভোঁতা হয়ে গেছে।আনমনেই
বাড়িতে হাটঁতে লাগলো নিঝুম।
হাটঁতে গিয়ে ওর চোখ চলে গেল
আতিফের রুমের দিকে।
কী মনে করে রুমে প্রবেশ করলো।
ছেলেটার ড্রয়ার খুললো ।
ঘাটাঘাটি করতে ইচ্ছা করছে খুব।
ড্রয়ার খুলে নিঝুম কিছু
চিঠি পেল। খোলা চিঠি। নিঝুম
চিঠিগুলো পড়া শুরু করলো একটার
পর একটা।
মা,কেমন আছো তুমি?
আমি আসলে জানি না ওই
জগতে তুমি কেমন আছ।বাবাও
তোমার জগতের
বাসিন্দা হয়ে গেছে।
তুমি কোনো দিনই আমার
চিঠি পাবে না।তাতে কী!
আমি তোমাকে চিঠি লিখেই
যাব।২ দিন
আগে একটি মেয়েকে দেখেছি আমি।
মা,মানুষের
চেহারা যে এতো মায়াবি হতে পারে তা আমার
জানা ছিলনা।আমি মেয়েটার
পিছু পিছু মেয়েটার
বাড়ি গেলাম।খোঁজ
নিয়ে জানতে পারলাম
মেয়েটার নাম নিঝুম।
কিছুদিনের মাঝেই মেয়েটার
বিয়ে।আমার হৃদয়টা হাহাকার
করে উঠলো। কিছু না পাওয়ার
একটা তীব্র
অনুভূতি সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই।
আসলে প্রথম দেখায়
কাউকে এতো ভালো লাগতে পারে এ
ব্যাপারটা আমার ঠিক
জানা ছিল না।যেখানেই
যাচ্ছি শুধু ওই নজরকাড়া মুখের
ছবি ভেসে উঠছে।রাতেও ঘুম
হচ্ছে না ঠিকমতো।-আতিফ । শেষ
চিঠিটা।
আরেকটা চিঠি পড়তে শুরু
করলো নিঝুম। মা,আজ আমার খুব কষ্ট
হচ্ছে।নিঝুমের
বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।আমার
খুশি হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু
আমার কষ্ট হচ্ছে। কারণ নিঝুম
হাসপাতালে।
তুমি বেঁচে থাকলে তো দোয়া করতে পারতে।-
আতিফ এই চিঠিটাও শেষ। এবার
আরেকটা পড়তে শুরু করলো নিঝুম ।
মা,আমার নিঝুমের ব্রেন
টিউমার হয়েছে।
জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার
করতে হবে।প্রচুর টাকা দরকার।
কিন্তু মেয়েটার বাবার
কাছে এত টাকা নেই।তার উপর
উনার নাকি অনেক টাকা ঋণ
রয়েছে।মা, এই মুহূর্তে আমার
ব্যবসাও তেমন
ভালো যাচ্ছে না।ব্যাংকেও
টাকা নেই এখন।মা,তুমি কিছু
মনে করো না। আমি তোমার
স্মৃতি বিজরিত বাড়িটা বন্ধক
রেখেছি।মেয়ের বাবাকে সেই
টাকা দিয়েছি।
চুক্তি অনুসারে ৪
মাসে টাকা ফেরত
দিতে না পারলে আমি মালিকানা হারবো।
তুমি চিন্তা করো না। আমি বন্ধক
ছুটিয়ে বাড়িটা ফেরত আনব।আর
তোমার ছেলের পছন্দের মানুষ
বেঁচে গেলে তুমি নিশ্চয়
খুশি হতে বেঁচে থাকলে। -আতিফ
। আরেকটা চিঠি খুলল নিঝুম। মা,
গত এক সপ্তাহ ঘুমাই নি।
আসলে ঘুমানোর সুযোগ পাই নি।
মেয়েটার জন্য অনেক
ছোটাছুটি করতে হয়েছে।
আল্লাহর রহমতে অস্ত্রোপচার সফল
হয়েছে।আমি ওর
বাবাকে বলে দিয়েছি আমার
এই সাহায্যের কথা নিঝুম যেন
কোনো দিন জানতে না পারে।-
আতিফ ।
এবার নিঝুম হাতে নিল
আতিফের লেখা সর্বশেষ চিঠি।
মা, আমি দুঃখিত।তোমার
স্মৃতি বিজরিত
বাড়িটি আমি বন্ধক
থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারি নি।
তার উপর কারখানায় আগুন
লেগে অনেক ক্ষতি হয়েছে।
আমি এখন
নিঝুমকে নিয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছি।
আমি অবশ্য এসব কিছুই
নিঝুমকে জানাই নি।তাতে ও
হয়তো কষ্ট পাবে। আর ও একটু কষ্ট
পেলে আমি দ্বিগুণ কষ্ট পাবো।
আমি এখন নতুন করে আবার
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
জানো মা,সারাদিন
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর অনেক
রাতে আমি বাসায় ফিরি।তখন
লুকিয়ে লুকিয়ে জানালা দিয়ে ঘুমন্ত
নিঝুমের স্নিগ্ধ চেহারার
দিকে তাকালে আমার সব
ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।এই
মুখটি একবার দেখার জন্য
আমি সবকিছু করতে পারি।
সবকিছুর বিনিময় হলেও আমি ওই
মায়াভরা মুখখানা দেখতে চাই
আজীবন ধরে। নিঝুম আর
পড়তে পারছে না চিঠিটা। ওর
চোখের
লোনা পানিতে চিঠিটা ভিজে গেছে।
বহুদিন পরে কাঁদছে নিঝুম।ওর
বোকামির জন্য কাঁদছে।ওর
ভালোবাসার আসল
মানুষটাকে এতদিন
চিনতে না পারার ব্যর্থতায়।
... দরজায় শব্দ হচ্ছে।আতিফ
এসেছে।
নিঝুম
ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
আতিফ কিছু
বুঝে উঠতে পারছে না। নিঝুম
ফিসফিস করে বললো,
"এতো ভালোবাসো কেন
আমাকে?" হতবিহবল আতিফ
নিঝুমের অশ্রুভেজা চোখের দিকে তাকালো।মুহূর্তেই
নিঝুমের চোখের সব
ভাষা পড়ে নিল। মনের
অজান্তে আতিফের চোখ
থেকেও অশ্রুধারা নেমে আসল।
আতিফ আর নিঝুমের চোখের
পানি মিলেমিশে একাকার
হয়ে গেছে মেঝেতে।আতিফ
আর নিঝুমের চোখ্
থেকে নেমে আসা অশ্রুধারা এক
মোহনায় এসে মিলিত হয়েছে।
এই মোহনা সৃষ্টি করবে নতুন
সমুদ্রের। এই
সমুদ্রটা ভালোবাসার সমুদ্র।
যে সমুদ্রে পাওয়া যাবে পারষ্পরিক
বিশ্বাস আর সুখ।